এখনো নায়িকা সুবর্ণা মুস্তাফা!
চৌষট্টিতেও প্রাণবন্ত সুবর্ণা
আমাদের অপর্ণা সেন কে জানতে চাইলে এক পলকে যার ছবিটা মনের জানালায় উঁকি দিয়ে যায়, তিনি সুবর্ণা মুস্তাফা। কর্মে ও জীবনযাপনে তাদের মিলের চেয়ে হয়তো অমিলই বেশি। কিন্তু অকপট সাহস আর সততায় তারা দুজনেই যে এক। আর অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহসে ভর করেই তিনি, সুবর্ণা ঘর বেঁধেছিলেন সন্তানের জনক হুমায়ূন ফরিদীর সঙ্গে সেই ১৯৮৬ সালে। তারপর ভালোবাসা ফুরিয়ে গেলে মোটেও দ্বিধা করেননি ২২ বছরের সংসারের খাঁচা ভেঙ্গে ফেলতে। অবশেষে অনেক রটনা আর ঘটনার সমাপ্তি টেনে ৬৪ ছুঁই ছুঁই এই চিরসবুজ নায়িকা আবারো ভালোবাসার মালা পরালেন এক তরুণ তুর্কির গলায়!
[caption id="attachment_584" align="alignnone" width="630"] সুবর্ণা মুস্তাফা[/caption]
তাদের সদ্য সংসার পাতার খবর শুনে এই সমাজের যারা জিভে কামড় দিলেন, বললেন, করেছে কী সুবর্ণা! ৩২ বছর বয়সী, হাঁটুর সমান এক ছেলেকে বানিয়েছে স্বামী! তারা জেনে রাখুন-পশ্চিমের পপ তারকা ম্যাডোনার বয়স ৪৯, তার স্বামী গাই রিচির বয়স মাত্র ৩৯! বলা যাক ডেমি মুরের কথাও। কারণ বছর কয়েক আগে দীর্ঘদিনের সংসার ছেড়ে এই হলিউডি নায়িকা বিয়ে করেছেন ১৫ বছরের ছোট অ্যাস্টন কুচারকে। সুসান সারানডন আর টিম রবিন্সের বয়সের ব্যবধানও তো মাত্র ১২ বছর। জানেন তো, ৪১ বছরের হ্যালি বেরি লিভ টুগেদার করছেন ৩১ বছরের গ্যাব্রিয়েল অব্রির সঙ্গে। যদি চান তাহলে এই তালিকা আরো লম্বা হবে, নিশ্চিত!
পশ্চিমের চটকদার ব্যাপার বলে মুখ ঘুরিয়ে নিতে চাইলে বলা উচিত, সম্প্রতি বলিউড তারকা ঐশ্বরিয়া ও অভিষেকের যে বিয়ে হলো মহাধুমধামে সেখানেও কনের চেয়ে বর ২ বছর ২ মাসের ছোটই ছিলেন।
মাইকেল ডগলাস ৩১ বছরের ছোট ক্যাথেরিন জেটা জোন্সকে বিয়ে করলে যদি কোন দোষ না হয় তাহলে কেন সমালোচনা হবে ম্যাডোনা, বা ডেমি মুরের কিংবা আমাদের সুবর্ণা মুস্তাফার।
সুবর্ণা সবসময়ই সময়ের চেয়ে একধাপ এগিয়ে চলেছেন। থেকেছেন নিজের মতো করেই। তাকে নিয়েই এবারের প্রচ্ছদ- যাতে রইলো ভক্ত আর বন্ধুদের মতামত যাদের কাছে সুবর্ণা সুবর্ণাই, এক এবং অনন্য...
এক পলকে সুবর্ণা
বাবা গোলাম মুস্তাফা ছিলেন টিভি নাটক, চলচ্চিত্রের শক্তিমান অভিনেতা। আবৃত্তিকার হিসেবেও খ্যাতিমান। মা হোসনে আরাও ছিলেন ভালো অভিনেত্রী, নাট্যকার ও রেডিও প্রযোজক। তাই জন্মগতভাবেই এদেশের তুমুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুর্বণা মুস্তাফা বেড়ে উঠেছেন একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে।
ছোটবেলা থেকেই নানা সাংষকৃতিক কর্মকাণ্ডে ছিল তার প্রবল আগ্রহ। ভিকারুনন্নেসা নূন স্কুল আর হলিক্রস কলেজে পড়ার সময় তিনি ছিলেন এসব কাজে সবার সেরা। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হন, ততদিনে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের টিভি নাটকের পরিচিত মুখ। তারও আগে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন বেইলি রোডের মঞ্চে সীমিত পরিসরে। মূলত গত শতকের সত্তরের দশকের শেষ দিকে তিনি অভিনয়ে নিয়মিত হয়ে ওঠেন। আর ধীরে ধীরে নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে জাদুর মতো টানতে শুরু করেন এদেশের সর্বস্তরের টিভি দর্শককে। একবাক্যে বলতে গেলে- টেলিভিশনের এক এবং অপ্রতিদ্বন্দী নায়িকা আজও শেষ পর্যন্ত সুবর্ণা মুস্তাফাই।
যদিও এদেশের আর দশজন শিশুর তারও ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবেন। আর্ত-মানবতার সেবায় করবেন নিয়োজিত নিজেকে। কিন্তু রক্তে যার অভিনয় তার পক্ষে ক্যামরা-লাইট-অ্যাকশনের হাতছানি এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। অভিনেতা বাবারও ইচ্ছে ছিল না মেয়ে ছুরি, কাঁচি আর রক্ত নিয়ে দিনরাত পরে থাকুক। ফলে বাবার আগ্রহ আর নিজের অনন্যসাধারণ প্রতিভার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে কলেজের চৌকাঠ পেরুতে না পেরুতেই অষ্টাদশী সুর্বণা মুস্তাফা নেমে যান অভিনয়ে। এর পরের গল্প যেন সেই রাজকন্যার যিনি জীয়ন কাঠি হাতে রাঙিয়ে দিলেন এদেশের সব তরুণে হৃদয়।
এই বাংলাদেশে দশকের পর দশক ধরে কয়েক প্রজন্মের প্রিয়তম অভিনেত্রী হয়ে থাকার বিরল কৃতিত্ব শুধুমাত্র সুবর্ণা মুস্তাফারই। তিনি অভিনয়ই শুধু নয়, আবৃত্তিতে দারুণ। অভিনয়ের মতো আবৃত্তিতেও বাবাই তার প্রথম গুরু। নিতান্তই আবেগের বশে যে কলা তিনি শিখতে শুরু করেন অল্প দিনের মধ্যেই সেই আবৃত্তি তার সবচেয়ে প্রিয় শখ হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, উইলিয়াম সেক্সপিয়ার, জসীমউদ্দীনের কবিতা তার সবচেয়ে পছন্দের। উনিশ শতকের আধুনিক ইংরেজ কবি টিএস এলিয়টের কবিতা তাকে যাদুর মতো টানে। তার লেখা ‘দি ওয়েস্টল্যান্ড’ বহুবার আবৃত্তি করেছেন। আর সমসাময়িক কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান এবং মহাদেব সাহা তার বেশি ভালো লাগে।
আবৃত্তি, টিভি নাটকের সঙ্গে সুবর্ণা ২৫ বছর ধরে ঢাকা থিয়েটারের হয়ে মঞ্চে অভিনয় করেছেন। মঞ্চে অভিনয় সম্পর্কে তার মন্তব্য উদ্বৃতিযোগ্য। “অভিনয়ের ক্ষেত্রে শিল্পীর স্বাধীনতা থাকা উচিত। যাতে সে ইচ্ছে করলেই যে কোন গ্রু্রপে কাজ করতে পারে। এ ব্যাপারটা ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে পুরোমাত্রায় আছে। আমি সেটা আমাদের দেশেও দেখিয়ে দিতে চাই।” অথচ নিজ দলেই অভিনয়ের প্রাপ্য সুযোগ না পাওয়ার বেদনায় মঞ্চ ছেড়েছেন সুবর্ণা মুস্তাফা।
সুবর্ণা অভিনয় করেছেন বেশ কিছু বাংলা চলচ্চিত্রেও। সেখানেও তার সহ অভিনেতা ছিলেন চিরপরিচিত মঞ্চ ও টেলিভিশনের সহকর্মীরাই। যথা আফজাল কিংবা ফরিদী। সুবর্ণার মতে, “চলচ্চিত্রই একজন শিল্পীর চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত।”
নানা কারণে চলচ্চিত্রে তিনি বেশি সময় দেননি। মঞ্চে তিনি দাপটের সঙ্গে থাকলেও সেখানে তার দর্শক ছিল সীমিত। ফলে টিভি নাটকের মাধ্যমেই এদেশের মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন তিনি। সুবর্ণা মুস্তাফাকে মানুষ বারবার টিভি নাটকের কারণেই বেশি পছন্দ করেছে। ‘বরফ গলা নদী’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘পারলে না রুমকি’, থেকে শুরু করে ‘আজ রবিবার’, ‘কোথাও কেউ নেই’ সহ অসংখ্য টিভি নাটক দিয়ে তিনি জয় করেছেন দর্শকচিত্ত। এখনো সে বিজয় রথ চলমান। তরুনরা এখনো তার ভক্ত। বদরুল আনাম সৌদ তাদেরই একজন।
মাঝে বেশ কিছুদিন টিভি নাটকে তিনি তেমনভাবে উপস্থিত না থাকলেও বেশ কিছু এক পর্ব, ধারাবাহিক ও ডেইলি সোপের মাধ্যমে বাংলা টিভি নাটকের চিরসবুজ এই নায়িকা আবার দর্শকচিত্ত হরণ করতে শুরু করেছেন।
মঞ্চে সুবর্ণা মুস্তাফার প্রিয় নাটক ‘শকুন্তলা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ ইত্যাদি। আর পরিচালক হিসেবে তার পছন্দ মামুনুর রশীদ, আলী যাকের, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু।
নিজের অভিনয় সম্পর্কে সুবর্ণা বলেন, “আমি কখনোই চরিত্র নিয়ে মাথা ঘামাইনি। অভিনয় করতে চেয়েছি, শুধুই অভিনয়।”
তার প্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রীদের মধ্যে রয়েছেন- আবুল হায়াত, ফেরদৌসী মজুমদার, আসাদুজ্জামান নূর, হুমায়ূন ফরিদী, ওয়াহিদা মল্লিক জলি এবং আরো অনেকে।
পরের প্রজন্মের মধ্যে তানিয়া, তারিন ও জীতুকে তার সম্ভাবনাময় বলে মনে হয়েছে।
সুবর্ণা ১৯৮২ সালে ‘নতুন বৌ’ নাটকে অভিনয়ের জন্য জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। তিনি নিজেও কিছু মঞ্চ ও টিভি নাটক পরিচালনা করেছেন।
সুবর্ণা মুস্তাফার প্রেম এবং বিবাহ সবসময়েই আলোচিত হয়েছে গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের কাছে। এক সময় আফজাল সুবর্ণার সম্পর্ক নিয়ে অনেক গসিপ ছাপা হয়েছে বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িকীতে। এরপর তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন হুমায়ূন ফরিদী। আজো হুমায়ূন ফরিদী ও সুবর্ণার প্রেম কাহিনী সবার মুখে মুখে ফেরে। কেউ ভোলে নি, বেলি ফুলের মালা দিয়ে সুবর্ণাকে বরণ করে নিয়ে ছিলেন হুমায়ূন ফরিদী (অনেকেই জানেন, ফরিদী প্রথম বিয়েও করেছিলেন এই বেলি ফুল দিয়ে)। ১৯৮৬ সালে সুবর্ণা বাংলা নাটকের এই শক্তিমান অভিনেতার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সুবর্ণার এটি প্রথম ও ফরিদীর দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম সংসারে ফরিদীর একটি মেয়ে রয়েছে।
একটানা ২২ বছর দাম্পত্য জীবন শেষে সুবর্ণা ২০০৮ সালে ১৮ মার্চ ফরিদীকে উকিলের মাধ্যমে তালাকের আবেদন করেন আদালতে। ১৮ জুন এই তালাক কার্যকর হয়।
ইতোমধ্যে তার সঙ্গে সখ্য এবং প্রণয় গড়ে ওঠে নবীন পরিচালক ও অভিনেতা বদরুল আনাম সৌদের। ২৬ জুন সুবর্ণা মুস্তাফার মা হোসনে আরা মৃত্যুবরণ করেন। ফরিদীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর থেকে তিনি মায়ের সাথেই উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের এই বাড়িতে বসবাস করছিলেন। এখানেই তিনি মায়ের মৃত্যুর ১১ দিন পর ৩২ বছর বয়সী সৌদকে বিয়ে করেন। সুর্বণার বর্তমান বয়স ৬৪ বছর।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মুহাম্মদ আলমগীর চৌধুরী (আলমগীর রানা) । 01819-393591 পৃষ্ঠপোষক: হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। উপদেষ্টামণ্ডলি : আলহাজ্ব মো. নাছির উদ্দিন চৌধুরী। সম্পাদকীয় কার্যালয়: ৭৩/৯ নূর মুহাম্মদ মার্কেট (৩য় তলা), টেরীবাজার, চট্টগ্রাম। যোগাযোগ: 01813-295129, [email protected], [email protected]
Copyright © 2025 বাণিজ্যিক রাজধানী. All rights reserved.