
কক্সবাজার পর্যটনের বড় বিজ্ঞাপন
কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের পাশে হিমছড়ি এলাকা। ছবি- মহিউদ্দিন আহমদ শাহীন
ইব্রাহিম খলিল মামুন, কক্সবাজার
বাংলাদেশে পর্যটনের কথা বললে সবার আগে নাম আসে কক্সবাজারের। বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন বালুকাময় সৈকত এখানে। দেখা মেলে বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশির। অবগাহন করা যায় সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে।শুধু সমুদ্রসৈকত নয়, অনন্য প্রাকৃতিক দৃশ্য, পাহাড়, জলপ্রপাত, বৌদ্ধমন্দির পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নিরিবিলি পরিবেশ, শীতল বাতাস মন ছুঁয়ে যায়। তাই সারাবছরই কক্সবাজারে লেগে থাকে পর্যটকের ভিড়। আন্তর্জাতিক পর্যটকদের মধ্যেও এর রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন গত ছয়-সাত বছর ধরে কক্সবাজারকে নতুন করে চেনাচ্ছে। প্রতিবছর প্রকৃতিপ্রেমী দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ইকো রিসোর্টে ভিড় করছেন।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের প্রধান আকর্ষণ হলো এর ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বালুকাময় সমুদ্রসৈকত, যা বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সৈকত হিসেবে স্বীকৃত। এর বিস্তীর্ণ প্রান্তর আর নীল সমুদ্রের ঢেউ যেন দিগন্তজোড়া বিস্তার লাভ করে। সমুদ্রের নির্মল বাতাসে হাঁটা, সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখা কিংবা সমুদ্রের জলে পা ভিজিয়ে হেঁটে বেড়ানোর অনুভূতি আপনার জীবনে নতুন আনন্দের সূচনা করবে। সৈকতের বালুকার জমিনে শুয়ে বা বসে থেকে পুরো দিন কাটানো যেন আপনার দৈনন্দিন ক্লান্তি দূর করতে সক্ষম। এ ছাড়াও কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে বসে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা প্রত্যেক পর্যটকের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা। সমুদ্রের বুকে সূর্যের প্রথম আলো দেখা কিংবা সূর্য ডোবার মুহূর্ত ভ্রমণকারীদের মন জুড়াতে পারে।
হিমছড়ি জলপ্রপাত প্রকৃতির আরেকটি বিস্ময় কক্সবাজারের সামান্য দূরেই অবস্থিত হিমছড়ি, যা পাহাড় আর জলপ্রপাতের মিলনে তৈরি এক অপূর্ব স্থান। এখানে পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে গড়িয়ে আসা পানির ধারা আর সবুজ পাহাড় আপনার মনকে প্রশান্তি দেবে। পাহাড়ি পথে হেঁটে ওপরে উঠলে সমুদ্র এবং সবুজের অনন্য দৃশ্যপট আপনার চোখে ধরা পড়বে। আর বর্ষাকালে হিমছড়ির জলপ্রপাতের ধ্বনি ও সৌন্দর্য বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য হিমছড়ি প্রকৃতির এক অনবদ্য উপহার।
ইনানী সৈকতকক্সবাজারের আরেকটি সৌন্দর্যের প্রতীক হলো ইনানী সৈকত। বালু ও প্রবালমিশ্রিত এ সৈকত অপেক্ষাকৃত শান্ত এবং নিরিবিলি। এখানে সমুদ্রের পানির রং স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার, যা পর্যটকদের নীরবতা ও প্রশান্তির সন্ধান দেয়। ইনানী সৈকতের পাথরগুলোও বিশেষ আকর্ষণ তৈরি করে, যা সৈকতের সঙ্গে এক অন্যরকম সৌন্দর্য যোগ করে। সৈকতের নির্জনতা এবং প্রাকৃতিক শোভা আপনাকে প্রশান্তি ও মানসিক শীতলতা দেবে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ কক্সবাজার থেকে সামান্য দূরেই অবস্থিত সেন্টমার্টিন, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এই ছোট্ট দ্বীপের শান্ত স্রোত এবং নীল জলরাশি পর্যটকদের মনোমুগ্ধ করে তোলে। নৌকা ভ্রমণ করে আপনি এ দ্বীপে পৌঁছে দেখতে পাবেন প্রবালের অপূর্ব সৌন্দর্য। দ্বীপের চারপাশে হেঁটে বেড়ানো, স্কুবা ডাইভিং বা স্নরকেলিং করে সমুদ্রের নিচের জগৎ আবিষ্কার করার সুযোগ পাবেন। সৈকতের প্রবাল এবং অন্যান্য সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য আপনার ভ্রমণকে করে তুলবে অনন্য।
রামু বৌদ্ধমন্দির সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাক্ষী কক্সবাজারের আরেকটি আকর্ষণীয় স্থান হলো রামু বৌদ্ধমন্দির। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এই মন্দিরে বিশালাকার বুদ্ধমূর্তি ও নানা প্রাচীন ধর্মীয় প্রতীক দেখা যায়। রামুতে অবস্থিত মন্দিরগুলোতে গিয়ে আপনি বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন। এখানে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত মন্দিরগুলো শুধু ধর্মীয় স্থান নয়; বরং এগুলোর স্থাপত্যশৈলীও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঐতিহ্য আর ইতিহাসের এই মেলবন্ধন ভ্রমণকারীদের নতুন অভিজ্ঞতা এনে দেয়।
সোনাদিয়া দ্বীপ নিভৃত প্রকৃতির কোলে সোনাদিয়া দ্বীপটি তার নির্জনতা ও প্রাকৃতিক শোভায় ভরপুর। এখানে কোনো জনবসতি নেই, যা একে করে তুলেছে আরও মনোমুগ্ধকর। যদি আপনি প্রকৃতির একান্ত নিরিবিলি পরিবেশে কিছু সময় কাটাতে চান, সোনাদিয়া হতে পারে আপনার জন্য আদর্শ স্থান। বিশাল বালুকাময় তটরেখা, নীল জলরাশি আর সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে এক নতুন অভিজ্ঞতা পাবেন। এটি কক্সবাজারের একটি বিশেষ গন্তব্য।
কক্সবাজারে থাকার ব্যবস্থাকক্সবাজারে বিভিন্ন বাজেটের জন্য থাকার ব্যবস্থা আছে, যেমন আন্তর্জাতিক মানের বিলাসবহুল হোটেল, রিসোর্ট, বাজেট হোটেল ও মোটেল। আপনি আপনার পছন্দ ও বাজেট অনুযায়ী তিনতারকা, চারতারকা বা পাঁচতারকা হোটেল, বিচ হোটেল, বাজেট হোটেল বা মিড-রেঞ্জের হোটেল বেছে নিতে পারেন।কম খরচে থাকতে চাইলে ৫০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা প্রতি রাতের জন্য বাজেট হোটেল খুঁজে নিতে পারেন।দুই হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা প্রতি রাতে মিড-রেঞ্জের হোটেল পাওয়া যায়। পাঁচ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে অনেক প্রিমিয়াম হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে, যেখানে উন্নত মানের সুবিধা থাকে। কক্সবাজার হোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারে বিভিন্ন মানের সাড়ে পাঁচশ আবাসিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে প্রতিদিন গড়ে এক লাখ ৮৬ হাজার পর্যটকের জন্য রাত্রিযাপনের সুযোগ রয়েছে।কক্সবাজার হোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, পর্যটকদের ভিড় বেশি থাকার কারণে, বিশেষ করে পিক সিজন (অক্টোবর থেকে মার্চ মাস) ভ্রমণের পরিকল্পনা করলে, আগে থেকে হোটেল বুকিং করে নেওয়া ভালো।
পর্যটন ব্যবসাকক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘মূলত পর্যটনসংশ্লিষ্ট পাঁচটি খাতে ব্যবসা বিবেচনায় নেওয়া যায়– আবাসিক হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউস, রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য খাবারের দোকান, সৈকতকেন্দ্রিক সেবা (যেমন– কিটকট, বাইক, ঘোড়া, ফটোগ্রাফি), দোকানপাট (যেমন– শুঁটকি, বার্মিজ পণ্য) এবং পরিবহন (দূরপাল্লার ও অভ্যন্তরীণ)।’তিনি জানান, কক্সবাজারে পর্যটন ব্যবসার সঠিক সংখ্যা নির্ধারণে কোনো সরকারি বা বেসরকারি পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা অনুযায়ী প্রতিবছর ১২ হাজার কোটি টাকার পর্যটন ব্যবসা হতে পারে।
যেভাবে বাড়ছে পর্যটন বাজারপাহাড়-সমুদ্র আর নদী-বনের মেলবন্ধন কক্সবাজার। কক্সবাজার শহরে এলে বোঝার উপায় নেই এটি টিলাভূমি। একের পর এক পাহাড় কাটা পড়েছে, গড়ে উঠেছে অন্তত ৫০০ হোটেল-মোটেল। এত কিছুর পরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি পর্যটন। মাঝখান থেকে ক্ষতি হয়েছে স্থানীয় মাটি, মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের। পরিবেশের ক্ষতি করে এমন জীবিকা পৃথিবীজুড়ে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আশার আলো দেখাচ্ছে পরিবেশবান্ধব (ইকো) পর্যটন।পরিবেশের কথা মাথায় রেখে ইতোমধ্যে এই জেলায় গড়ে উঠেছে অন্তত ১০টি ইকো রিসোর্ট। এসব রিসোর্ট সাধারণত শহরের বাইরে। গ্রামীণ পরিবেশে বাঁশ, কাঠ ও শন দিয়ে তৈরি। এগুলো তৈরিতে পরিবেশের ক্ষতি করে এমন উপাদান ব্যবহার করা হয় না। দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় পচনশীল পণ্য। এদের রয়েছে নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। তরল বর্জ্য খাল বা সমুদ্রে ফেলা হয় না। আর কঠিন বর্জ্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পৌঁছে দেওয়া হয় পৌরসভায়।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জমির উদ্দিন বলেন, কক্সবাজার পর্যটন এলাকা হওয়ায় যত্রতত্র দালানকোঠা নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য কাটা হয় পাহাড়, নষ্ট করা হয় জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল। সুতরাং প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রেখে বাঁশ, কাঠ ও শন দিয়ে ইকো রিসোর্ট নির্মাণ সত্যি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ ইকো ট্যুরিজম সম্প্রসারণে উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন।